হ-বাংলা নিউজ : আজ পর্তুগালের বেনফিকার এস্তাদিও দা লুজে ইউরোপসেরা হওয়ার লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে পিএসজি ও বায়ার্ন মিউনিখ।
আক্রমণাত্মক ফুটবলে দুই দলই ওস্তাদ, গোল দিতেই আগ্রহ বেশি তাদের। তবু অধিকাংশের মত, বায়ার্নই ম্যাচে ফেবারিট। অনেকেই ভেবেই নিয়েছে, নিজেদের ষষ্ঠ শিরোপাটা হয়তো এবারই ঘরে তুলবে বাভারিয়ানরা। এর পেছনে কারণ আর কিছুই নয়, কোয়ার্টার-সেমি ফাইনালে বায়ার্নের সর্বগ্রাসী রূপ। ফাইনালে ওঠার পথে লিওনেল মেসির বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলে রীতিমতো বিধ্বস্ত করেছে জার্মান পরাশক্তিরা।
প্রকৃতপক্ষে এতটাও সহজ নয় ব্যাপারটা। ফুটবলে সহজ বলে কোনো কিছু নেই যে! পিএসজিও ফাইনালে উঠেছে নিজেদের যোগ্যতায়। এই মৌসুমে কৌশলগতভাবে অকুতোভয় ফুটবল খেলে ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করে নেওয়া আতালান্তার জয়যাত্রা তারা রুখে দিয়েছে কোয়ার্টারে। সেমিতে লাইপজিগকে থামিয়ে দিয়েছে দুর্দান্ত দলগত রসায়ন দেখিয়ে। ফলে বায়ার্নের নাম শুনে ফাইনালে পিএসজি যে নিজেদের গুটিয়ে বসে থাকবে, এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই।
মেসি-রোনালদো ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাধর দুজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় কে? এই প্রশ্নের উত্তরে শতকরা নব্বই জন হয়তো বলবেন নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পের নাম। দুজনই খেলেন পিএসজির হয়ে। ২০১৭ সালে বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে যোগ দেওয়া নেইমারের জন্য এই ম্যাচটা অবশেষে নিন্দুকদের মুখ থামিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামি তারকা হয়ে পিএসজিতে যাওয়া এই তারকা ইউরোপীয় অঙ্গনে নতুন ক্লাবের হয়ে এখনো তেমন কিছু জিততে পারেননি। একই কথা বলা চলে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় এমবাপ্পের ক্ষেত্রেও। দুজনের জন্যই ম্যাচটা তাই ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় অপূর্ণতা মেটানোর উপলক্ষ।
নেইমার-এমবাপ্পেদের এই অপূর্ণতা মেটানোর জন্য ফাইনালে ফেবারিট বায়ার্নকে হারাতে হবে পিএসজির। এবং সেটা করার জন্য দুর্দান্ত পরিকল্পনা ও মাঠের মধ্যে তার সফল বাস্তবায়ন অতি জরুরি। দেখা যাক, কেমন হতে পারে সে পরিকল্পনা!
খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজ নিজ ছকে পরিবর্তন আনতে চাইবে না বায়ার্ন কিংবা পিএসজি। বায়ার্নের কথাই ধরা যাক। গোটা মৌসুম ৪-২-৩-১ ছকে খেলা দলটা এই ম্যাচেও যে একই ছকে খেলবে, এটা না বলে দিলেও চলছে। একাদশও থাকবে কোয়ার্টার বা সেমির মতোই—অপরিবর্তিত। গোলবারে বিশ্বস্ত ম্যানুয়েল নয়্যারের সামনে দুই সেন্টারব্যাক ডেভিড আলাবা (বাম) ও জেরোম বোয়াটেং (ডান), দুই ফুলব্যাক আলফোনসো ডেভিস (বাম) ও ইওশুয়া কিমিখ (ডান), রক্ষণভাগের চারজনের সামনে থিয়াগো আলকানতারা ও লিওন গোরেৎস্কার মিডফিল্ড, আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে টমাস মুলার, দুই উইংয়ে সার্জ নাব্রি ও ইভান পেরিসিচ, স্ট্রাইকে রবার্ট লেভানডফস্কি।
তবে চোট থেকে ফিরে আসা দুই ডিফেন্ডার রাইটব্যাক বেঞ্জামিন পাভার ও সেন্টারব্যাক নিকলাস সুলেও জানিয়ে দিয়েছেন, সুযোগ পেলে মূল একাদশে থাকার জন্য প্রস্তুত তাঁরাও। পাভার যদি রাইটব্যাক খেলেন, তাহলে গত দুই ম্যাচে পাভারের জায়গায় খেলা কিমিখ খেলবেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে, আলকানতারার পাশে—যে জায়গায় মৌসুমের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কিমিখ। সে ক্ষেত্রে বেঞ্চে বসে পড়বেন গোরেৎস্কা। ওদিকে সুলেকে খেলানো হলে মূল একাদশ থেকে জায়গা হারাবেন বোয়াটেং। তবে এই দুই পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ওদিকে পিএসজি যথারীতি তাদের পছন্দের ৪-৩-৩ ছকে খেলবে। চোট সমস্যার কারণে নিয়মিত গোলরক্ষক কেইলর নাভাস সেমিতে খেলেননি, তবে ফাইনালে তাঁকে পাওয়া যাবে, মোটামুটি নিশ্চিত। রক্ষণভাগে জুটি বাঁধবেন প্রেসনেল কিমপেম্বে ও থিয়াগো সিলভা, দুই ফুলব্যাক হুয়ান বের্নাত (বাম) ও থিলো কেহরার (ডান)। মিডফিল্ডের তিনজনের মধ্যে স্পেনের আন্দের হেরেরা আর ব্রাজিলের মার্কিনিওসের জায়গা নিশ্চিত। এখন এ দুজনের সঙ্গী কে হবেন, সে জন্য লড়াই করবেন লিয়ান্দ্রো পারেদেস ও মার্কো ভেরাত্তি। অন্য যেকোনো সময় হলে চোখ বন্ধ করে বলা যেত ভেরাত্তিই খেলবেন। কিন্তু ভেরাত্তি সদ্য চোট থেকে ফিরেছেন। গত ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করেছেন পারেদেস। ফলে সকল হিসেব উলটে গেছে। ভেরাত্তির জায়গায় যদি পারেদেসও খেলেন, আশ্চর্যের কিছু হবে না। মিডফিল্ডে জায়গা পাওয়ার জন্য লড়াই করবেন আইভরি কোস্টের ইদ্রিসা গানা গেয়েও।
গত দুই ম্যাচে বায়ার্নের জয়ের রসায়ন ছিল আক্রমণভাগের সাফল্য। ফলে রক্ষণভাগেও যে তাদের খামতি আছে একটু, সেটা ঢাকা পড়ে গেছে। কোয়ার্টার ফাইনালের কথাই ধরুন। বায়ার্ন বার্সেলোনাকে আট গোল দিয়ে সবার চোখ কপালে তুলে দিয়েছে। তা না হলে বায়ার্নের রক্ষণে যে হালকা হলেও ফাটল আছে, সেটা কিন্তু ওই ম্যাচে দেখা গেছে। বায়ার্ন গোল খেয়েছে দুটো, প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
একই ঘটনা ঘটেছে লিওঁর বিপক্ষে সেমিফাইনালেও। বেশ কয়েকবার মেম্ফিস ডিপাই, কার্ল-তোরো একাম্বি কিংবা ম্যাক্সওয়েল কর্নেটরা গোল করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কখনো বল বারে লেগেছে, কখনো ভালোভাবে শট নিতে পারেননি, আবার কখনো ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন নয়্যার। আর এই ফাটলের মূলে রয়েছে কোচ হান্সি ফ্লিকের অতি আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা।
বায়ার্ন রক্ষণভাগের চারজনকে মাঠের অনেক ওপরে খেলাতে অভ্যস্ত, যেটাকে ‘হাই লাইন ডিফেন্স’ বলা হয়। মাঠের একদম মূল মধ্যরেখা বরাবর রক্ষণভাগের চারজন দাঁড়িয়ে থাকেন। কারণ একটাই, মিডফিল্ড যেন আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা পায়। এর ফলে আরেকটা সুবিধা হয়, দুই সেন্টারব্যাক আলাবা-বোয়াটেংয়ের মাঝখানের জায়গায় নেমে গিয়ে অনেকটা ছদ্ম-সেন্টারব্যাকের ভূমিকা নেন থিয়াগো আলকানতারা, সেখান থেকে আক্রমণভাগে নিখুঁত পাস পাঠান।
রক্ষণভাগকে হাই লাইনে খেলানোর কারণে গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার আর আলাবা-বোয়াটেংদের মধ্যে ফাঁকা জায়গা থাকে অনেক বেশি। বার্সেলোনা হোক বা লিওঁ, মূলত এই ফাঁকা জায়গাটা কাজে লাগাতে চেয়েছে বারবার। প্রথম দল মেসি ও সেমেদো এবং দ্বিতীয় দল ডিপাই-একাম্বির গতি দিয়ে। আবার বার্সা ও লিওঁর অর্ধ থেকে থেকে আলাবা-বোয়াটেংদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ন্ত বল পেছনের ফাঁকা জায়গায় ফেলার একটা প্রবণতাও দেখা গিয়েছে। ফলে এগিয়ে থাকা বায়ার্ন ডিফেন্ডাররা অনেক সময় পেছনে দৌড়ে ট্যাকল করার পর্যাপ্ত সময় পান না।
এই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয় বায়ার্নের ডানদিকের দুই ডিফেন্ডার কিমিখ ও বোয়াটেংয়ের ক্ষেত্রে। জেরোম বোয়াটেং তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করে এসেছেন তাও প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল। গার্দিওলা যাওয়ার পর কার্লো আনচেলত্তি, হেইঙ্কেস, নিকো কোভাচ—কোনো কোচই বোয়াটেংকে আর অবিচ্ছেদ্য ভাবছিলেন না। অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে তিনটি কারণে—নতুন কোচ হান্সি ফ্লিকের আগমন, নিকোলাস সুলার চোট ও বোয়াটেংয়ের নিজের ফর্মের উন্নতি। ফলে বোয়াটেং এখন বায়ার্ন রক্ষণভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তাঁর একটা দুর্বলতা চোখে পড়ছে অনেক।
ফ্লিকের ‘হাই লাইন’ ডিফেন্স ভেদ করে প্রতিপক্ষ বোয়াটেং এর দিক দিয়ে আক্রমণ করলে তাড়াতাড়ি পেছনে চলে আসতে পারেন না এই জার্মান সেন্টারব্যাক।
একই কথা রাইটব্যাক কিমিখের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিমান খেলোয়াড় বলা হয় কিমিখকে, যিনি একাধিক পজিশনে খেলতে সমর্থ। অনেকের মতে, রাইটব্যাক কিমিখের চেয়ে মিডফিল্ডার কিমিখ আরও বেশি ক্ষুরধার। এই মৌসুমে লিওন গোরেৎস্কার পাশাপাশি কিমিখই খেলছিলেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে। বাধ সাধে নিয়মিত রাইটব্যাক বেঞ্জামিন পাভারের চোট।
পাভারের চোটের কারণে মিডফিল্ড থেকে আবারও রাইটব্যাকে ফিরে আসতে হয় কিমিখকে, আর কিমিখের ফেলে আসা জায়গায় খেলা শুরু করেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার থিয়াগো আলকানতারা। কিমিখ আর থিয়াগো, নিজ নিজ পজিশনে দুজনই খেলছেন দুর্দান্ত। ফলে পাভার সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও ফাইনালে সুযোগ পাবেন কি না, বলা যাচ্ছে না। তবে এটাও সত্যি কথা, গতির দিক দিয়ে কিমিখের চেয়ে আবার পাভার ভালো। একটু আগে যে সমস্যাটার কথা বলা হচ্ছিল, ফ্লিকের ‘হাই লাইন’ ডিফেন্স ভেদ করে প্রতিপক্ষ বোয়াটেং-কিমিখের দিক দিয়ে আক্রমণ করলে তাড়াতাড়ি পেছনে চলে আসতে পারেন না দুজন। কিমিখের জায়গায় পাভার থাকলে তুলনামূলকভাবে তাই রক্ষণটা আরেকটু বেশি নিরাপত্তা পায়।
এখন কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালের পরীক্ষিত ফর্মুলার বাইরে গিয়ে কোচ হান্সি ফ্লিক পাভার, সুলাদের মাঠে নামান কি না, সেটা দেখার বিষয়। আর যদি সেটা না-ও করেন, তাহলে অতি আক্রমণাত্মক কৌশলের সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। বায়ার্নের রক্ষণভাগ নিয়মিত যত উঁচুতে উঠে যায়, তার চেয়ে একটু হলেও নিচে নামতে হবে। না হয় যে সুযোগগুলো সেমিতে ডিপাই বা একাম্বিরা মিস করেছেন, নেইমার-এমবাপ্পেরাও যে করবেন, সেটা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না। যেখানে নেইমার ও এমবাপ্পে, বিশ্বের দ্রুতগতির ফুটবলারদের মধ্যে অন্যতম। মানের দিক দিয়ে যারা অবশ্যই ডিপাই বা একাম্বির চেয়ে ভালো।
তবে বায়ার্ন যদি ‘হাই লাইন ডিফেন্সে’ বোয়াটেং-কিমিখদের গতির কথা চিন্তা করে রক্ষণভাগের লাইনটা একটু নিচে নামায়, সে ক্ষেত্রে মিডফিল্ডে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পেয়ে যাবেন নেইমার। আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হলেও, প্রায় সময়েই ম্যাচের মধ্যে নিচে এসে খেলা গড়ে দিতে চান এই ব্রাজিল তারকা। নেইমার নিচে নেমে আসলে ওপরের ফাঁকা জায়গাটায় দ্রুত দৌড়ে চলে যেতে পারেন এমবাপ্পে, গোল করার জন্য সুবিধাজনক জায়গায়। ফলে এমবাপ্পে যাতে রক্ষণের পেছনে ফাঁকা জায়গা না পান, সেটা নিশ্চিত করতে গেলে নেইমার আবার মিডফিল্ডে ফাঁকা জায়গা পেয়ে যাচ্ছেন। এ যেন উভয়সংকট বায়ার্নের জন্য!
সংকট কাটানোর উপায় একটাই, মিডফিল্ডকে এমন একজনকে রাখতে হবে, যিনি নেইমারকে চোখে চোখে রাখার পাশাপাশি সুবিধামতো ওপরে উঠে আক্রমণে যোগ দিতে পারেন। থিয়াগো আলকানতারা প্রায় সময় ছদ্ম সেন্টারব্যাক হিসেবে খেললেও প্রতিপক্ষকে আটকে রাখার কাজটা তাঁকে দিয়ে ভালো হয় না। তাই এই কাজটা করার জন্য ফ্লিকের হাতে আছে দুটি উপায়—
দায়িত্ব নিতে হবে লিওন গোরেৎস্কাকে। জার্মান এই মিডফিল্ডার প্রায়ই ওপরে উঠে গিয়ে লেফানডফস্কি-মুলারদের সঙ্গে আক্রমণে যোগ দেন। এই ম্যাচে নিজের এই স্বভাবে একটু লাগাম টানতে হবে।
গোরেৎস্কা/থিয়াগোর মধ্যে যেকোনো একজনের জায়গায় খেলাতে হবে কিমিখকে, সে ক্ষেত্রে রাইটব্যাক হিসেবে খেলবেন পাভার। তবে উইনিং কম্বিনেশন ভেঙে ফ্লিক এমনটা করবেন বলে মনে হয় না।
তবে যে-ই খেলুক না কেন, পিএসজি অবশ্যই চাইবে নেইমার-এমবাপ্পের গতি ব্যবহার করে বায়ার্নের এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে।
বায়ার্ন যদি শেষমেশ হাই লাইন ডিফেন্সেই খেলে, সে ক্ষেত্রে ম্যানুয়েল নয়্যারের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘সুইপার কিপার’ হিসেবে নিজেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক বানানো নয়্যারের কাজ হবে গোলরক্ষকের কাজ করার পাশাপাশি বাড়তি একজন ডিফেন্ডারের ভূমিকা পালন করা, বিপদ আঁচ করে সামনে এগিয়ে এসে এমবাপ্পে বা নেইমারের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া।
এবার আসা যাক বায়ার্নের আক্রমণভাগে। লেফানডফস্কিকে ওপরে রেখে পেছনে নাব্রি, মুলার ও পেরিসিচ। চারজনের মূল কাজ আক্রমণ করা হলেও আরেকটা ক্ষেত্রে চারজনই নজর কেড়েছেন। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে দুর্দান্তভাবে প্রেস করে বল কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে সফলতা দেখাচ্ছেন চারজনই। এর মধ্যে লেফানডফস্কির ভূমিকা থাকে ওপর থেকে একটু নিচে নেমে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে প্রেস করে তাঁর খেলা নষ্ট করে দেওয়ার। যে কাজটা তিনি কোয়ার্টারে বার্সেলোনার বুসকেটসের বিপক্ষে দুর্দান্তভাবে করেছিলেন। প্রায়ই লেভানডফস্কির প্রেসে দিশেহারা হয়ে নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছিলেন না বুসকেটস।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে প্রেস করার জন্য লেফানডফস্কি নেমে এলে দুই উইঙ্গার নাব্রি ও পেরিসিচের কাজ হয় প্রতিপক্ষের দুই সেন্টারব্যাককে প্রেস করা, ফলে সেন্টারব্যাক দ্বয় ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের মধ্যে যোগাযোগটা নষ্ট হয়। সুবিধা পেয়ে যান লেভানডফস্কিরা। এই কাজটা আজকেও করতে চাইবে বায়ার্ন। বায়ার্নের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মার্কিনিওসকে নিচে নেমে প্রেস করবেন লেভা, আর দুই সেন্টারব্যাক সিলভা ও কিমপেম্বেকে প্রেস করবেন বায়ার্নের দুই উইঙ্গার নাব্রি ও পেরিসিচ। মুলারের কাজ হবে এই তিন প্রেসিংয়ের মধ্যে নিজের ও সতীর্থদের জন্য জায়গা খুঁজে বের করা। গোল করার জন্য সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় বসে থাকা। যে কাজটা বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে করে যাচ্ছেন মুলার। ফ্লিক আসার পর মুলারের ফর্মেরও উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট।
লেভা-মুলার-পেরিসিচ-নাব্রির আরও একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, কেউই নিজের জায়গায় স্থির থাকেন না। চারজনের মধ্যে ক্রমাগত জায়গার পরিবর্তন হয়। ফলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররাও একটু ধন্দে পড়ে যান। ক্রমাগত জায়গা পরিবর্তনের পাশাপাশি আক্রমণে উঠলে সময়-সুযোগমতো চারজন ডি-বক্সে গিয়ে বসে থাকেন (কখনো যোগ দেন কিমিখ বা গোরেৎস্কাও)। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি যেন না হয়, সে ব্যাপারে নজর রাখতে হবে পিএসজির চার ডিফেন্ডার ও এক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে।
এখন প্রশ্ন হলো, বায়ার্নের এই চার খেলোয়াড়কে কীভাবে আটকাবে পিএসজির রক্ষণভাগ? একটা সমাধান হতে পারে, ৪-৩-৩ ছকে নামলেও মাঠে রক্ষণ করার সময় ৪-৪-২ ছকে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। চারজন ডিফেন্ডার ও চারজন মিডফিল্ডারকে থাকতে হবে অত্যন্ত কাছাকাছি, ও নিচু লাইনে রক্ষণ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যেন তাঁদের সঙ্গে গোলরক্ষক নাভাসের দূরত্ব বেশি না থাকে।
নেইমার আর এমবাপ্পে যেহেতু রক্ষণ করার জন্য নিচে নামতে অতটা আগ্রহী নন, সেহেতু পিএসজির পায়ে বল না থাকলে আক্রমণভাগের বাঁয়ে থাকা ডি মারিয়াকে নিচে নামতে হবে ক্রমাগত। হুয়ান বের্নাতের সঙ্গে জুটি বেঁধে আটকাতে হবে বায়ার্নের ডানদিক থেকে ক্রমাগত ভেতরে ঢুকতে চাওয়া নাব্রিকে। তিন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার (মার্কিনিওস, হেরেরা, ভেরাত্তি) এর মধ্যে ডানদিকে থাকতে হবে হেরেরাকে। এর আগে প্রতিপক্ষের সেরা খেলোয়াড়ের কার্যকারিতা কমিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রশংসা কুড়ানো হেরেরার ওপর দায়িত্ব থাকবে বায়ার্নের বামদিকে থাকা পেরিসিচকে আটকানো, ও একই সঙ্গে মুলারের জায়গা খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করার। সঙ্গে প্রতি আক্রমণের জন্য ভেরাত্তি (বা পারেদেস) যাতে ওপরে নিখুঁত পাস পাঠাতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে এই হেরেরাকে (বা হেরেরার পরিবর্তে যদি ইদ্রিসা থাকেন-তাঁকে)। এমবাপ্পে আর নেইমার যেহেতু নিচে নামবেন না রক্ষণের জন্য, সেহেতু তাঁদের ভূমিকা থাকবে শুধু বায়ার্নের রক্ষণভাগের পেছনের জায়গার সদ্ব্যবহার করা।
তবে বায়ার্নের মতো পিএসজিও যদি হাই লাইন ডিফেন্সে খেলে, সে ক্ষেত্রে ফরাসি দলটার লাভ হবে না। কারণ বায়ার্নের আক্রমণভাগের চারজন নিয়মিত জায়গা পরিবর্তন করে করে খেলার কারণে কখনো না কখনো একজন বের হয়েই যায়, যে কিনা মার্কিং এড়িয়ে গোল করার জন্য সুবিধাজনক জায়গায় চলে যেতে পারেন। প্রতিপক্ষ হাই লাইনে খেললে থিয়াগো বা কিমিখ নিচ থেকে সফলভাবে ‘প্লে-মেক’ (খেলা গড়ে দেওয়া) করে বল ওপরে পাঠাতে পারেন, এমনটা বেশ কয়েকবার দেখা গেছে এই মৌসুমে। এই সমস্যার সমাধানও বের করতে হবে পিএসজিকে। এবং এই ক্ষেত্রেও খোলা চোখে মনে হচ্ছে পিএসজি যদি নিচে নেমে জমাট বেঁধে খেলে, তাতেই বরং লাভ হবে নেইমারদের।
আরেকটা ক্ষেত্রেও সুবিধা পেতে পারে পিএসজি। এই মৌসুমে বায়ার্নের লেফটব্যাক আলফোনসো ডেভিস খেলছেন দুর্দান্ত। কী আক্রমণ, কী রক্ষণ—সব দিক দিয়েই অনন্য তিনি। তবে একটু খুঁটিয়ে যারা খেলা দেখেন, তারা বুঝবেন, একজনের বিপক্ষে রক্ষণ করতে গেলে (ওয়ান-টু-ওয়ান ডিফেন্ডিং) একটু হলেও খেই হারিয়ে ফেলেন এই তারকা। ফলে তাঁর দিক থেকে সফল ক্রস দেওয়াটা প্রতিপক্ষ দলের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ। এ ব্যাপারটার সুবিধা নিতে চাইবে পিএসজি।
ওদিকে বায়ার্নের সুবিধার জায়গা হলো তাদের দুই ফুলব্যাক। পিএসজির দুই ফুলব্যাকের চেয়ে বায়ার্নের দুই ফুলব্যাক মানের দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে। ওদিকে ৪-৩-৩ ছকে পিএসজির যে তিনজন মিডফিল্ডার খেলবেন, তাঁরা সাধারণত অত ছড়িয়ে খেলতে পছন্দ করেন না, কেন্দ্রীভূত থাকেন। ফলে উইংয়ে জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকে কিছু কিছু সময়ে। সে জায়গাটার সদ্ব্যবহার করতে হবে ডেভিস-কিমিখদের।
কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনাল, দুই ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ম্যাচের শুরুর কিছুক্ষণ নিজেদের গুছিয়ে নিতে একটু সময় নেয় বায়ার্ন। পরে আস্তে আস্তে ম্যাচের লাগাম টেনে ধরে। বার্সেলোনা বা লিওঁ—দুই দলই এই সময়ে বেশ কয়েকটা আক্রমণ করেছিল। গোল পায়নি, সেটাকে দুর্ভাগ্যই বলা চলে। নিজেদের ঝলক দেখানোর জন্য নেইমার ও এমবাপ্পে যদি এই সময়টাকে বেছে নেন, ম্যাচে এগিয়ে যেতে পারে পিএসজি। আর ম্যাচে প্রতিপক্ষ দল একবার এগিয়ে গেলে সে ম্যাচ বের করে আনার ব্যাপারে ফ্লিকের বায়ার্ন কতটুকু পটু, সেটা এখনো অত ভালোভাবে দেখা যায়নি। লিগে বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে ম্যাচটাই যেমন, লিওন বেইলির গোলে এগিয়ে যাওয়া লেভারকুসেন শেষমেশ ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে।
নিরপেক্ষ ফুটবল ভক্তদের জন্য ম্যাচটা যে অত্যন্ত আনন্দদায়ী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ সামান্যই। নেইমার না লেফানডফস্কি, শেষে হাসি কে হাসে সেটাই এখন দেখার বিষয়।