হ-বাংলা নিউজ, করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই জাপানের লোকজনকে বড় সময় ধরে বাড়িতে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার মুখে সরকার ভাইরাসের বিস্তার রোধে পদক্ষেপ হিসেবে অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ-পানশালা সবই বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছিল। ফলে মানুষের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না। পাশাপাশি সংক্রমণ-আতঙ্কও অনেক মানুষকে ঘর থেকে বের হওয়ায় নিরুৎসাহিত করে।
ফলে ধারণা করা হয়েছিল যে পারিবারিক জীবনে এক সাথে কাটানো বিরল সময় জাপানে হয়তো শিশু জন্মের হার বছরের শেষ দিকটায় ওপরের দিকে ঠেলে দেবে। তবে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, ফল হয়েছে ঠিক উল্টো। জাপানে নারীর গর্ভধারণের হার বিগত মাসগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি আতঙ্কও কাজ করেছে। জাপানে শিশু জন্মের স্থান হচ্ছে হাসপাতাল। করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে অনেক হাসপাতাল ভাইরাসের রোগীতে পরিপূর্ণ। ফলে সেরকম এক জায়গায় সন্তান জন্মের জন্য উপস্থিত হওয়া সম্ভ্যাব্য মায়েরা ভালোভাবে দেখছেন না
মে মাস থেকে পরবর্তী তিন মাস সময়ে সারা দেশ জুড়ে নারীর গর্ভধারণের হার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৪ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার খবর দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে আগামী বছর জাপানে শিশু জন্মের হারকে এটা যথেষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে ঠেলে দেবে।
মন্ত্রণালয় অবশ্য প্রত্যাশার বিপরীত এই প্রপঞ্চের জন্য করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবকে দায়ী করছে। মানুষের মনে বাসা বেঁধে নেওয়া সুপ্ত আতঙ্ক, স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করায় পারিবারিক জীবনের ওপর এর প্রভাব এসে পড়ে এবং এ কারণেই মানুষ এখন আর আগের মতো পারিবারিক জীবনের অন্তরঙ্গতা উপভোগ করতে পারছে না।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে জাপানে ইতিমধ্যে হ্রাস পাওয়া জন্মহার পরিস্থিতির আরও ব্যাপক অবনতি ভবিষ্যতে হবে। গত বছর জাপানে মোট ৮ লাখ ৬৫ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছিল। জনসংখ্যা ধরে রাখার জন্য এটা কোনো অবস্থাতেই পর্যাপ্ত নয়। এখন ধারণা করা হচ্ছে যে এ বছরের মে-জুলাই মাসের ধারা ভবিষ্যতে বজায় থাকলে ২০২১ সালে জাপানে ৮ লাখের কম শিশুর জন্ম হতে পারে।
নারীর গর্ভধারণ হারে সবচেয়ে বড় হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে মে মাসে, এই হার যখন ১৭.১ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। এরপর পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও এক বছর আগের তুলনায় তা আর বৃদ্ধি পায়নি। মে-জুলাই ত্রৈমাসিক সময়ে জাপানে নারীর গর্ভধারণের মোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৪৮২, এক বছর আগের চাইতে যা ২৬,৩৩১টি কম।
গর্ভধারণ হার হ্রাসের কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকেরা করোনাকালীন সামাজিক অবস্থার প্রতি দিকনির্দেশ করছেন। করোনাভাইরাস জাপানের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যে অবস্থা থেকে দেশটি এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি।
মে মাস থেকে পরবর্তী তিন মাস সময়ে সারা দেশ জুড়ে নারীর গর্ভধারণের হার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৪ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার খবর দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে আগামী বছর জাপানে শিশু জন্মের হারকে এটা যথেষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে ঠেলে দেবে
প্রচুর লোকজন চাকরি হারিয়েছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি জাপানের বিশাল আকারের উৎপাদন খাতের অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। কেউই এরা মুনাফার হিসাব দিচ্ছে না, বরং উল্টোভাবে লোকসানের দোহাই দিয়ে কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে আনার দিকে নজর দিচ্ছে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আয় গেছে কমে, জীবন হয়ে পড়েছে অনেক বেশি অনিশ্চিত। সেরকম অবস্থায় এমনকি সদ্য বিবাহিত অনেক পরিবারকেও সন্তান নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
পাশাপাশি অন্য একটি আতঙ্কও এখানে কাজ করেছে। জাপানে শিশু জন্মের স্থান হচ্ছে হাসপাতাল। করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে অনেক হাসপাতাল ভাইরাসের রোগীতে পরিপূর্ণ। ফলে সেরকম এক জায়গায় সন্তান জন্মের জন্য উপস্থিত হওয়া নতুন মায়েরা ভালোভাবে দেখছেন না।
নবাগত শিশুর জন্মহারে পতনের আরেকটি অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে কর্মজীবী জনসংখ্যা আরও সংকুচিত হয়ে আসা ছাড়াও জাপানের ইতিমধ্যে বৃদ্ধ হয়ে আসা সমাজের আরও বেশি বৃদ্ধ হয়ে পড়া। জাপান ইতিমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বৃদ্ধ সমাজের একটিতে পরিণত হয়েছে, বয়োজ্যেষ্ঠ, পেনশন-নির্ভর মানুষের আনুপাতিক হার যেখানে প্রতি চারজনে একজনের চাইতে বেশি। রাষ্ট্রের জন্য এটা অবশ্যই বড় এক মাথাব্যথার কারণ।
মহামারির কারণেই মানুষ এখন আর আগের মতো পারিবারিক জীবনের অন্তরঙ্গতা উপভোগ করতে পারছে না
সেরকম অবস্থায় করের আয় কমে যাওয়ার বিপরীতে চিকিৎসা ও পেনশন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের সার্বিক সমাজ নিরাপত্তা খাতের ওপর সুদূর প্রসারী প্রভাব এর মধ্যে দিয়ে পড়ে। ফলে করণীয় কি হতে পারে তা নিয়ে জাপানের নীতি নির্ধারকেরা অনেক দিন থেকেই ভাবছেন এবং নানা বিকল্পের ভালো-মন্দ দিকগুলো তারা খুঁটিয়ে দেখছেন।
এদের অনেকেই বলছেন বিদেশি শ্রমশক্তির জন্য দেশের বন্ধ দুয়ার দ্রুত খুলে দেওয়া ছাড়া বিকল্প অন্য কোনো পথে যাত্রা করার সুযোগ জাপানের সামনে এখন আর নেই। তবে সেই পথেও যে অর্থনীতির উদ্ধার লাভ সম্ভব হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা করোনা আক্রান্ত কালে পাওয়া যাচ্ছে না। আর এ কারণেই গর্ভধারণ ও জন্মহার হ্রাসের সাথে সম্পর্কিত সবগুলো বিষয় দেশের সার্বিক অবস্থার আলোকে বিবেচনা করে দেখে সমাধান খুঁজে পাওয়ার যৌক্তিকতার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন সমাজ গবেষকেরা। তবে তা করতে হলে আরও যা দরকার হবে তা হলো, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম কেন এখন আর সন্তান নিচ্ছে না তা খুঁজে দেখে একই সাথে সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার দিকেও এগিয়ে যাওয়া।
তথ্যঃ সংগ্রহীত