হ-বাংলা নিউজ : সরকার পতনের ডাক দিয়ে হঠাৎই রাজধানীর পুরানা পল্টন-জিরো পয়েন্ট এলাকায় বসে যাওয়ার পাশাপাশি সিনিয়র দুই নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে তাৎক্ষণিক ‘শোকজ’ নোটিস দেওয়া নিয়ে বিএনপিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিষয়টি দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীরই অজানা। কারা গুটিকয় নেতা-কর্মীকে এভাবে সরকার পতনে উদ্বুদ্ধ করল- তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। দুই নেতাকে শোকজ নিয়েও স্পষ্ট ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারছেন না। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, এ ঘটনায় বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সরকারও। সোমবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের দিন সন্ধ্যায় বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) দেয় বিএনপি। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। শওকত মাহমুদকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এবং মেজর হাফিজকে পাঁচ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। এর মধ্যে শওকত মাহমুদ শোকজের জবাব দিয়েছেন। অন্যদিকে মেজর হাফিজ আগামীকাল বেলা ১১টায় নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন।
জানা যায়, সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে পেশাজীবী পরিষদ একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খানসহ বিএনপির বেশ কিছু নেতা-কর্মী এতে অংশ নেন। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যসহ হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা-কর্মীকেও দেখা যায় সেখানে। দুপুরে সমাবেশ শেষ করে নেতা-কর্মীরা পল্টন মোড়ে গিয়ে সরকার পতনের স্লোগান দিয়ে একপর্যায়ে বসে পড়েন। তাদের মাথায় ক্যাপ ও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। ওই সময় বায়তুল মুকাররম মসজিদে বাদ জোহর হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর জানাজাও শেষ হয়। সেখান থেকেও হেফাজতের নেতা-কর্মীরা পল্টন মোড়ে এসে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় সেখানে কল্যাণ পার্টির সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বিএনপির শওকত মাহমুদ, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক খান ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিক বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। মুহূর্তেই পল্টন ও জিরো পয়েন্ট এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে পুলিশ নেতা-কর্মীদের কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে এবং লাঠিপেটা শুরু করলে তারা দ্রুত ওই এলাকা ছেড়ে যান।
এরপর সন্ধ্যায় শওকত মাহমুদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমদকে শোকজ করে বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, দলের নাম ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্ত করে সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে কেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- সে বিষয়ে শওকত মাহমুদকে ৭২ ঘণ্টা এবং হাফিজ উদ্দিন আহমদকে পাঁচ দিনের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত জবাব জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একটা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী কখনোই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারেন না। এটা তো একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে আছে। আমাদের মধ্যে নানা মত থাকতেই পারে। সেটি হবে দলীয় ফোরামে। ওপেন কোনো জায়গায় তো আমরা কোনো কথা বলতে পারি না। আমরা যদি দল বা দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলি, তাহলে জনগণ কী ভাববে! এটা তো হতে পারে না।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শোকজের চিঠি পেয়েছি। চিঠির উত্তর প্রস্তুত করছি। শনিবার বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে নিজের অবস্থান তুলে ধরব।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি, ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরও কয়েকটি ছোট দলের কিছু নেতা বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে ব্যাংকক ও নেপালে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কোনো মহলের সবুজ সংকেত পেয়ে তারা তৃতীয় বৃহত্তর শক্তির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে চান। আলোচনা আছে, কয়েকটি প্রভাবশালী দেশও তাদের সহযোগিতা করছে। বিএনপির হাইকমান্ডের অভিযোগ, বিশেষ একটি গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে ‘সরকার পতনের’ পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে দলেরই একটি অংশ। সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ নানা স্থানে মানববন্ধনসহ বেশ কিছু কর্মসূচিতেও এসব নেতাকে দেখা যায়। তারাই বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। সূত্রমতে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য, কয়েকজন ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, একাধিক যুগ্ম-মহাসচিব, বিভিন্ন সম্পাদকীয় পর্যায়ের কয়েকজন নেতা, সাবেক বেশ কিছু ছাত্রনেতা, একাধিক তরুণ নেতা, কয়েকজন মহিলা নেত্রী, মুক্তিযোদ্ধা দল, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি সম্প্রতি বিএনপির হাইকমান্ড অবগত হন। সর্বশেষ সোমবার পেশাজীবী সমাবেশে দলের নেতাদের পক্ষ থেকে না যাওয়ার জন্যও বলা হয়। এ কারণে দু-একজন বাদে প্রায় সব নেতাই পল্টনে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। জোট ও ফ্রন্টের বেশ কয়েকজন নেতা এই প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকলেও আশপাশের এলাকা থেকে ওই কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করেন।
একপর্যায়ে যখন বুঝতে পারেন, বড় কোনো কিছু হচ্ছে না, তখন যে যার মতো চলে যান। তবে কাউকে বহিষ্কার করা হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে এমন শঙ্কায় বিএনপির হাইকমান্ড তাদের শোকজেই সীমাবদ্ধ রাখছেন বলে জানা গেছে। এদিকে পেশাজীবী পরিষদের ব্যানারে হঠাৎ বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচির আগের রাতে ঐক্যফ্রন্ট শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার রাজধানীর গুলশানের বাড়ি ঘেরাও করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় মান্না বাড়িতেই ছিলেন। একাধিকবার বাড়ির ফটকে গেলেও নিরাপত্তাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যায় পুলিশ। এদিকে বিএনপির তরুণ নেতা প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনের গোপীবাগের বাসভবনে হামলা চালানোর ঘটনাকেও রহস্যজনকভাবে দেখছেন অনেকেই। সার্বিক বিষয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন চাই। অন্য কোনো পথে এটা সম্ভব নয়। কয়েকজন লোক জড়ো করে বসে পড়লেই সরকার পতন হয়ে যায় না।’ এদিকে বিএনপির একটি সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বৈঠক করেছেন। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তারা প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন। এ সময় তারা চলমান সব পরিস্থিতি নিয়েই কথা বলেন বলে জানা গেছে।
তথ্যঃ সংগ্রহীত