হ-বাংলা নিউজ : যুক্তরাজ্যের লাখো মানুষের জন্য প্রযোজ্য চতুর্থ বা সর্বোচ্চ স্তরের বিধিনিষেধ আরোপের জন্য দায়ী করা হচ্ছে করোনাভাইরাসের নতুন একটি বৈশিষ্ট্য বা ভ্যারিয়ান্টকে। এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মানবশরীরে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসে ক্রিসমাসে মানুষের মেলামেশায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও আসছে ঠিক একই কারণে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস আগেও ইংল্যান্ডে যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না, কয়েক মাস পরে এসে সেই নতুন একটি বৈশিষ্ট্য-বিশিষ্ট করোনাভাইরাস কীভাবে এতটা ছড়িয়ে পড়লো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ব্রিটিশ সরকারের সংক্রমণ বিষয়ক উপদেষ্টারাও মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটা করোনাভাইরাসের অন্য ভ্যারিয়ান্টের তুলনায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সব কাজই এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখনো অনেক অনিশ্চয়তা এবং অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়েছে।
নতুন এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে কারণের উদ্বেগ বাড়ছে
মূলত তিনটি কারণে করোনাভাইরাসের নতুন এই ভ্যারিয়ান্টটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্রথমত, এটি ভাইরাসের অন্য সংস্করণগুলোকে প্রতিস্থাপিত করছে। দ্বিতীয়ত, এটির বিভাজন বা রূপান্তর ভাইরাসের কিছু অংশে পরিবর্তন আনে, যা গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, এসব বিভাজনের মধ্যে বেশ কিছু ল্যাবে পরীক্ষার পর দেখা গেছে, এগুলো মানুষের দেহের কোষকে সংক্রমিত করার ভাইরাসের যে সক্ষমতা তা বাড়ায়। এসব বৈশিষ্ট্য ভাইরাসটিকে সহজে ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা দেয়।
বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা এখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে নতুন স্ট্রেইনটি উপযুক্ত পরিবেশ পেলে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন লন্ডনের মতো জায়গা, যেখানে এর আগে পর্যন্ত দ্বিতীয় স্তরের বিধি-নিষেধ ছিল। ভাইরাসটির সংক্রমণ কমিয়ে আনতে এরই মধ্যে চতুর্থ পর্যায়ের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এটি যত দ্রুত ছড়ায়
সেপ্টেম্বরে প্রথম ভাইরাসের এই নতুন ধরণটি শনাক্ত করা হয়। নভেম্বরের দিকে লন্ডনে আক্রান্তদের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ ছিল নতুন বৈশিষ্ট্যের এই ভাইরাসের শিকার। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি দুই-তৃতীয়াংশে পৌছায়।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, এই বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসটি ৭০ শতাংশ বেশি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, এটা হয়তো ‘আর নাম্বার’ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, মহামারি কি আসলে ছড়িয়ে পড়ছে না-কি কমছে। এটা হিসাব করা হয় ০ থেকে ৪ এর মধ্যে।
৭০ শতাংশ বেশি হারে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে গত শুক্রবার ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ড. এরিক ভলজ-এর একটি উপস্থাপনায়। তিনি বলেন, ‘এটা এখনই বলা খুব কঠিন… কিন্তু এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাসটির অন্য যে কোন বৈশিষ্ট্যের তুলনায় এটি ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এর উপর নজর রাখতে হবে।’
তবে নতুন এই স্ট্রেইনটি কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার কোনো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তাকে জানিয়েছেন, এটি ছড়িয়ে পড়ার হার ৭০ শতাংশের কম বা বেশি হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে তথ্য জানা যাচ্ছে সেগুলো পর্যাপ্ত নয় এবং এগুলো অনুযায়ী কোনো দৃঢ় মতে পৌঁছানোও সম্ভব নয় যে ভাইরাসটি আসলেই বিশালভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।’
যত দূর ছড়িয়ে পড়েছে?
ধারণা করা হচ্ছে যে ভাইরাসের এই স্ট্রেইনটি যুক্তরাজ্যেই কোনো একজন রোগীর দেহে আর্বিভূত হয়েছে কিংবা এমন একটি দেশ থেকে এসেছে যেখানে ভাইরাসটিকে পর্যবেক্ষণ করার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে, শুধু উত্তর আয়ারল্যান্ড ছাড়া। কিন্তু এটি মূলত রাজধানী লন্ডন এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব ইংল্যান্ডেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অন্য এলাকাগুলোতে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।
ভাইরাসটির জেনেটিক কোড নিয়ে কাজ করা নেক্সটস্ট্রেইন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ডেনমার্ক এবং অস্ট্রেলিয়াতে যে ভাইরাসের স্ট্রেইনটি পাওয়া গেছে তা যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে। নেদারল্যান্ডেও নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে।
চীনের উহানে যে ভাইরাসটি প্রথমে শনাক্ত করা হয়েছিল, সেটির সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে থাকা ভাইরাসের কোনো মিল নেই। D614G নামে ভাইরাসটি গত ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপে ধরা পরে এবং এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি এই বৈশিষ্ট্যের। A222V নামে আরেকটি ভাইরাসের স্ট্রেইনও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্পেনে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় এটি বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
ভাইরাসটির নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা যা জানি
ভাইরাসটির নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রাথমিক একটি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে এবং এতে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসটির ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন কাজ করবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন এসেছে-এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটির মাধ্যমেই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। N501Y নামে চিহ্নিত একটি পরিবর্তনে স্পাইকের ওই জায়গায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর এসেছে, যা ‘রিসেপ্টর-বাইন্ডিং ডোমেইন’ নামে পরিচিত।
এর মাধ্যমেই ভাইরাসের স্পাইক মানুষের ত্বকের সঙ্গে প্রথম সংযোগ ঘটায়। যে কোনো ধরণের পরিবর্তন, যা এই ভাইরাসটিকে শরীরে সহজে প্রবেশ করতে সহায়তা করে, তা ভাইরাসটির জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
তথ্যঃ সংগ্রহীত