হ-বাংলা নিউজ : নববর্ষের প্রাক্কালে একটা খবর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। যুক্তরাজ্যে করোনার একটি নতুন স্ট্রেইন ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। রূপান্তরিত এই ভাইরাসের জিনোমে অন্তত ১৭টি পরিবর্তন ঘটেছে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। এর ফলে চিকিৎসার সংকট বাড়বে। অন্যদিকে, এই নতুন স্ট্রেইনের করোনা আগের করোনাভাইরাসের চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি দ্রুত ছড়ায়। ভয়ের দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, এত দ্রুত ছড়ালে তো করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। আর দ্বিতীয়ত, যে টিকার অপেক্ষায় আমরা আছি, সেটা কি নতুন স্ট্রেইনগুলোর অ্যান্টিবডি তৈরিতে সফল হবে? এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চললে তেমন সমস্যা হবে না। আর এখন যেসব ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে, ওগুলো এই নতুন স্ট্রেইনেরও অ্যান্টিবডি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
রোগ প্রতিরোধে বাড়তি সমস্যার মুখে পড়তে হবে না। এখন এই নতুন স্ট্রেইন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান চলাচল স্থগিত রেখেছিল, এখন শিথিল করছে। আমাদের দেশও সতর্কতা নিয়েছে। যুক্তরাজ্য থেকে কোনো যাত্রী বাংলাদেশে আসার পর নির্ধারিত কিছুদিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। এ ধরনের কড়াকড়ি ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি বাইরে চলাফেরায় সবার মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আমরা চাই না যে করোনার নতুন কোনো স্ট্রেইন সংক্রমণের নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করুক। সবাই সতর্ক থাকলে যুক্তরাজ্যের করোনার নতুন স্ট্রেইন তেমন বিপজ্জনক হবে না।
করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনগুলো কতটা ভয়ের?
করোনাভাইরাসের নতুন কোনো স্ট্রেইনের কথা শুনলেই আমরা আতঙ্কিত হই। কারণ, নতুন ধরনের ভাইরাস রোগীদের জন্য হয়তো আরও বেশি কষ্টদায়ক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। করোনাভাইরাসের হাজার হাজার মিউটেশন প্রতিনিয়ত হচ্ছে এবং এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভাইরাসের নতুন নতুন স্ট্রেইন। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, কোনো কোনো স্ট্রেইন তুলনামূলক বেশি ভয়াবহ। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো এ পর্যন্ত সব ধরনের স্ট্রেইনেই একটি মিল আছে, সেটা হলো করোনাভাইরাসের রিসেপ্টার-বাইন্ডিং ডোমেইনের স্পাইক প্রোটিনের উপস্থিতি। স্পাইক অপরিবর্তিত থেকে যায়, পরিবর্তন হয় তার ভেতরের কাঠামোয়। কোভিড-১৯–এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর স্পাইক প্রোটিন। এর সাহায্যেই ভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রের কোষের রিসেপ্টারকে পেঁচিয়ে ধরে তার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং কোষের চালকের আসনে বসে। এরপর ওই কোষগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থা ব্যবহার করে করোনাভাইরাস দ্রুত তার নিজের প্রোটিনের অনুলিপি তৈরি করতে থাকে। এইভাবে করোনাভাইরাস দ্রুত বংশবিস্তার করে রোগীকে কাবু করে ফেলে। শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করতে থাকে। রোগীর জীবন বিপন্ন হয়। অন্যদিকে, এর বিরুদ্ধে দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা মূলত করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের উপস্থিতি শনাক্ত করে সক্রিয় হয়। করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণকারী অথবা করোনা সংক্রমণের পর সুস্থ হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তির দেহে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি মূলত ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন চিনে রাখে এবং পরে সেই স্পাইক প্রোটিন দেখলেই তাকে ধ্বংস করে। সুতরাং করোনাভাইরাসের যত স্ট্রেইনই হোক, স্পাইক প্রোটিন থাকলেই শরীরের অ্যান্টিবডি তাকে সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। করোনার আশঙ্কা থাকে না।
কিন্তু কোনো মিউটেশনের ফলে হয়তো করোনার স্পাইক প্রোটিনেরও বিলুপ্তি ঘটতে পারে। তখন অ্যান্টিবডি সেই ভাইরাসকে চিনতে পারবে না এবং টিকায়ও কাজ হবে না। কিন্তু স্পাইক প্রোটিন না থাকায় একই সঙ্গে সেই নতুন স্ট্রেইনের করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের কোনো কোষকে আক্রমণও করতে পারবে না। কারণ, এই ভাইরাসের প্রধান অস্ত্র তার স্পাইক প্রোটিন। সেটাই যদি না থাকে, তাহলে করোনা তার ভয়াবহতা হারাবে। হয়তো দ্রুত ছড়াবে, আক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করবেন, কিন্তু শ্বাসকষ্ট বা অক্সিজেনের অভাবে জীবন বিপন্ন হবে না এবং একসময় করোনাভাইরাসের সেই স্ট্রেইন বিলুপ্ত হবে। তাই একদিকে নতুন স্ট্রেইন যেমন কিছু বাড়তি বিপদ ডেকে আনতে পারে, তেমনি আবার নতুন কোনো স্ট্রেইনে স্পাইক প্রোটিন না থাকলে সেই করোনাভাইরাস এক অর্থে নির্জীব হয়ে পড়বে।
করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান :
সম্প্রতি ব্লুমবার্গের তালিকায় করোনা মোকাবিলা–সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশ ২০তম অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকায় নিউজিল্যান্ড ৮৫ দশমিক ৬ পয়েন্ট পেয়ে প্রথম অবস্থানে আর বাংলাদেশ ৫৯ দশমিক ২ পয়েন্ট পেয়ে ২০তম অবস্থানে রয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় অবস্থানে নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ৩৭তম অবস্থানে। দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা মোকাবিলা–সক্ষমতায় প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে।
কয়েক দিন আগে এক টিভি টক শোয়ে প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি মনে করেন, শীতের সময় বাংলাদেশে কোভিডের প্রকোপ কমবে। কার্যত দেখা যাচ্ছে কয়েক দিন ধরে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী দেশে করোনা সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে হলেও কমে আসছে। এই ধারা বজায় থাকুক—এটাই আমাদের কাম্য।
তথ্যঃ সংগ্রহীত